সাগরের তীর থেকে মিস্টি কিছু হাওয়া এনে, তোমার কপালে ছোঁয়াবো গো ভাবি মনেমনে।


নীলু দ্রুত হাতে কাপড় গুলো ভাঁজ করতে লাগলো। সেই সাথে গুনগুন করে গাইতে লাগলো...
"সাগরের তীর থেকে মিস্টি কিছু হাওয়া এনে,
তোমার কপালে ছোঁয়াবো গো ভাবি মনেমনে।.. "

"মা..হাওয়া কি খাওয়া যায়??"
নীলুর ৬ বছরের মেয়ে নীলাদ্রি মিটমিট করে হেসে প্রশ্ন করলো।

নীলু ফিক করে হেসে ফেললো।
" কি খুব পচানো হচ্ছে মা কে, তাই না??"

"আরে নাহ, এইযে তুমি গাচ্ছিলে 'মিস্টি কিছু হাওয়া..' মনে হচ্ছিলো হাওয়া না তুমি হাওয়াই মিঠাই এর কথা বলছো"
গম্ভীর স্বরে বলল নীলাদ্রি।



"তবে রে দুষ্টু মেয়ে....খুব পাকামো হচ্ছে মায়ের সাথে না??"

বলেই মা মেয়ে দুজনেই খিলখিল করে হাসতে লাগলো।

"মা... তুমি সমুদ্র এতো ভালোবাসো কেন বলতো?? " অবাক হয়ে প্রশ্ন করে নীলাদ্রি।

"জানি নারে....তুই চল।
দেখবি তুইও ভালোবেসে ফেলবি...নীলাভ....ওই সমুদ্র টা কে। জগতের সকল কষ্ট তুচ্ছ হয়ে যায় রে ওর সামনে যেয়ে দাঁড়ালে।"

"তোমার কি অনেক কষ্ট মা??"

"ধুর বোকা!!...কষ্ট আসবে কোত্থেকে??
তুই আছিস না??
যা তো তাড়াতাড়ি তোর ওই নীল ফ্রক টা নিয়ে আয়, পরে কিন্তু ভুলে গেলেই সব মাটি হয়ে যাবে.."

নীলাদ্রি ছুটে যায়, আর ভাবতে থাকে,
"মা টা এতো বোকা কেন যে... অদ্ভুত সব চিন্তা খেলা করে মায়ের মাথায়...
সাগরের তীরে নীল ড্রেস, সূর্যাস্তে লালচে কমলা ড্রেস, আবার পাহাড়ের জন্য সবুজাভ ড্রেস। তাও আবার তিনজনের ম্যাচিং ম্যাচিং এর চেষ্টা।
যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মিলছে না। তাই শুধু নীলাদ্রির ড্রেস গুলোই মিলাচ্ছে মা।"

হিমাদ্রী বিরক্তি ভরে তাকালো নীলুর দিকে..
নীলু আতিপাতি করে আলমারি তে কিছু একটা খুঁজছে সেই তখন থেকেই।

"কি খুঁজছো সেই তখন থেকেই...
ওভাবে খুঁজলে ত হাতি বের হবার কথা আলমারি থেকে।" বিরক্তি ভরে প্রশ্ন করলো হিমাদ্রী।

"আর বলো না....আমার একটা নীল রঙের টাংগাইল শাড়ী ছিল, সেই বিয়ের আগের। সেটা আর খুঁজে পাচ্ছিনা। এখানেই রেখেছিলাম। সব কিছুই আছে অথচ শাড়ী টা ই নেই। কেমন লাগে বলো তো??"

"কোন নীল শাড়ী?? ওইযে যেটা তোমাকে দেখতে যাবার দিন পরেছিলে??"

"আরে!! হ্যা হ্যা ওইটাই তো..."

"ওটা এখানে নেই নীলু...তুমি ত জানো নীল রঙ আমার অসহ্য লাগে। মা তুলির মেয়ের জন্য কাঁথা বানাবার পুরোন শাড়ী খুঁজছিল, আমি ওটা দিয়ে দিয়েছি। ওটা ত পরা হয় না। তাই দিয়ে দিলাম।" নির্লিপ্ত ভাবে বললো হিমাদ্রী।

প্রচণ্ড বিস্ময়ে ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো নীলু...কিছু বলার ভাষা টাও হারিয়ে ফেললো যেন।

"তুমি....আমাকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করলে না??!!"

"না প্রয়োজন মনে করিনি। আর শোনো নীলু, নাটক করবা না, কিছু হলেই চোখে গঙ্গাযমুনা নামাবা না। সাগর দেখতে চেয়েছ, নিয়ে যাবো... এই নিয়ে এতো মাতামাতির কিছু নেই। বুঝসো? নিজের ত মাথানষ্টই এখন বাচ্চা মেয়েটার মাথাও খাচ্ছো।"

নীলুর চোখেরজল চোখেই শুকালো, এক ফোঁটাও গড়িয়ে পরলো না। আলমারির এক কোনে পরে থাকা নীল কাচের চুড়ি তে হাত বুলিয়ে ভাবলো,
" থাক না.... একটা শাড়ীই তো.."

"আচ্ছা, তুমি কি টিকেট কেটেছো?? তুমি ত সবকিছুই শেষ মুহুর্তের জন্য রেখে দাও।"
মৃদুস্বরে জানতে চাইলো নীলু।

"হুম, কেটেছি। নাও তোমার কাছেই রাখো, কাল সকালের বাস। সবকিছু গুছিয়ে নাও.."

"সকালে??.. সেকি!!...
আমাদের না নাইটে যাবার কথা ছিল??
হঠাৎ কেন ডিসিশন চেঞ্জ কর..."

কথা শেষ হবার আগেই থমকে গেলো নীলু,
অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলো হাতের টিকেট এর দিকে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো তার।

"শোনো নীলু ছুটিছাটায় বাচ্চাদের নানাবাড়ি দাদাবাড়ি বেড়াতে যাওয়াই ভালো। এবার যশোর বেড়িয়ে আসুক নীলাদ্রি, পরের বার নাহয় নানাবাড়ি যাবে। ও এখনো ছোট সমুদ্রের মজা বুঝার বয়স হয়নি ওর। বড় হোক তারপর যাবে নাহয়। এটা নিয়ে কোন আর্গুমেন্ট চাইনা আমি।"

"আমি কি কখনো আর্গুমেন্ট করেছি তোমার সাথে??..."

"না, করো নি......"

"তাহলে...?? থাক বাদ দাও।
আমি নীলাদ্রি কে বুঝিয়ে বলব। অসুবিধা নেই।"
ফেরীর রেলিঙ এ ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নীলু। পদ্মার হিম হিম বাতাসে ওর অবাধ্য চুল গুলো বার বার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

হিমাদ্রী বিরক্ত হয়ে বলল, "চুল টা বেধে ফেললেই ত পারো, কি যে করো না তুমি বুঝি না।"

"না....মা তুমি খোলা চুলেই থাকবে, আমার বেশ লাগে দেখতে।" শান্ত ভাবে বলল নীলাদ্রি।

"যেমন মা তেমনি মেয়ে...
তোমরা নদীর বাতাস খাও, আমি ভেতরে যেয়ে চা খাচ্ছি।" বলেই চলে গেলো হিমাদ্রী।

নীলু তার হাতের নীল কাচের চুড়ি একটি একটি করে খুলে নদীর জলে আলতো করে ছুড়ে দিতে লাগলো।

নীলাদ্রি জানে, তার মা টা খুব বোকা....
অভিমান টুকু নিজের মাঝেই লুকিয়ে রাখবে।

"মা...একটা কবিতা আবৃতি করো না...প্লিজ??"

নীলু ফিসফিস করে আউরে গেলো...

"একদিন ঠিক ছুঁয়ে দেবো নোনাজল...
একদিন ঠিক দক্ষিণা হাওয়ায় ওড়াবো খোলাচুল..
একদিন ঠিক দাঁড়াবো ভিজেবালির সৈকতে..
একদিন ঠিক দেখবো সূর্যস্নান বালিয়াড়ির তীরে..
একদিন ঠিক শুধাবো বিধাতা রে...
কি অপরাধে অপরাধী আমি তার তরে??
কেন সব স্বপ্নেরা চলে যায়...
আংগুলের ফাঁক গলে মিহি বালির মতন??
কেন করেছো আমায় সর্বঃসহা...অস্তিত্বহীন...??
কেন করোনি তবে,
আবেগ..অনুভূতিহীন..অন্তঃসারশুন্য?
কেন করেছো এতো বেশী অস্পৃশ্যা...অধরা..??
কেন জমেছে হৃদয়ের গোপন কুঠুরি তে
শত শত বিদ্রোহী অভিমান??
কেন করোনি কারো চোখে একজন মায়াবতী??
কেন দিয়েছ আমায় এক তরলিত আয়নার জীবন.....
হেসে যাই...খেলে যাই...
যাপিত জীবনের সকল আচার....
বুকফাটা আর্তনাদ দেখে না তো কেউ...
ভাগ্যবিধাতা এ তোমার কেমন বিচার???

একদিন ঠিক ছুঁয়ে দিবো সাগরের নোনাজল...
একদিন ঠিক মিশে যাবো নীলজলের অতল।
একদিন ঠিক হবো কারো চোখে একজন মায়াবতী,
একদিন ঠিক কেউ বলবে আমায়,
"ভালোবাসি তোমায় ওগো অভিমানী।

ছবি গুগল মামু।
সাগরের তীর থেকে মিস্টি কিছু হাওয়া এনে, তোমার কপালে ছোঁয়াবো গো ভাবি মনেমনে। সাগরের তীর থেকে মিস্টি কিছু হাওয়া এনে, তোমার কপালে ছোঁয়াবো গো ভাবি মনেমনে। Reviewed by poland Trending now Trends on December 19, 2017 Rating: 5

No comments:

Powered by Blogger.